বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনাকে পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আজ বুধবার প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনসংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে অন্তত দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণঘাতী বুলেট ব্যবহার করে শটগান দিয়ে একাধিক গুলি করেছেন।
এতে আরো বলা হয়, ‘হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সাঈদের মাথা মাটিতে আঘাত লাগে। কিন্তু মাথায় এমন কোনো গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পুলিশের একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘১৬ জুলাই ছাত্রলীগকর্মী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস ও ফাঁকা গুলিজ ছোড়ে।’
পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়, ‘আবু সাঈদ তখন গুরুতর আহত হন এবং পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
’ মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাথায় আঘাত ও গুলির আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও ভিডিও প্রমাণের ভিত্তিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন মনে করে, আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় পুলিশ সরাসরি জড়িত এবং দায়ী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পুলিশ ছাত্রলীগকর্মীদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলা চালায় এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং মারণঘাতী পিলেট ব্যবহার করে শটগান দিয়ে গুলি করে। পুলিশ গুলি শুরু করলে সাঈদ হাত মেলে ধরেন।
ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দেখা গেছে, তার এক হাতে বাঁশের লাঠি ছিল। কিন্তু প্রায় ১৪-১৫ মিটার দূরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য তা কোনো হুমকি ছিল না।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সাঈদ চিৎকার করে বলেন, ‘আমাকে গুলি করো।’ দুই পুলিশ কর্মকর্তা শটগান দিয়ে তার শরীরে একাধিক গুলি করেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন তাদের ডিজিটাল ফরেনসিক দল দিয়ে গুলির ভিডিও ও ছবি পরীক্ষা করেছে। এর মাধ্যমে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও সাঈদের হত্যার ঘটনার বিশ্লেষণ করা হয়।
ভিডিও থেকে সংগৃহীত ছবিতে দেখা যায়, অন্তত দুজন পুলিশ সদস্য সাঈদের ওপর গুলি চালান। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাঈদের কাঁধে লাল দাগ এবং তার শার্টে রক্তের দাগ দেখা গেছে। অন্যান্য ছবিতে তার হাত, বাহু, কনুই, ঘাড়সহ তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। সাঈদকে রক্তসহ থুতু ফেলতে দেখা গেছে, যা মেডিক্যাল প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে, গুলি সম্ভবত সাঈদের ঘাড় ও ফুসফুসে আঘাত করে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা বলেন, গুলি সম্ভবত তার ফুসফুসে আঘাত করেছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়েছে। জাতিসংঘের ফরেনসিক চিকিৎসক সাঈদের মেডিক্যাল রেকর্ড পর্যালোচনা করেছেন এবং দেখেছেন, আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মান অনুযায়ী ময়নাতদন্ত করা হয়নি।
চিকিৎসক সাঈদের শরীরের ছবিসহ চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রমাণাদি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে তার বুকের ডান পাশে অন্তত ৪০টি এবং বাঁ পাশে ৫০টি ধাতব পিলেট আঘাত করে, যেগুলো হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও পেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাছাকাছি ছিল।
ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাঈদকে প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে প্রাণঘাতী ধাতব পিলেট ভর্তি শটগান দিয়ে কমপক্ষে দুইবার গুলি করা হয়। ভিডিও ফুটেজের অধিকতর ফরেনসিক পরীক্ষায় সাঈদের ঘাড়, বুক এবং বাহু থেকে রক্তপাত দেখা গেছে, যার ফলে হাইপোভোলেমিয়া (রক্তচাপ কমে যাওয়া) এবং মাথা ঘোরার লক্ষণ দেখা গেছে।